অফিস পলিটিক্স: দক্ষতার পেছনে অদৃশ্য লড়াই
রেহানা ফেরদৌসী:
|
![]() অফিস পলিটিক্স: দক্ষতার পেছনে অদৃশ্য লড়াই “অফিস পলিটিক্স” আজ এক বিশেষ বাস্তবতা। ‘অফিস পলিটিক্স’-এর বদলে যদি ‘অফিস রাজনীতি’ বলা হয়, তাহলে এর আসল অর্থ ধরা যাবে না। “পলিটিক্স” শব্দের অনেক রকম প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন—ভিলেজ পলিটিক্স। অফিস পলিটিক্সে দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অদক্ষরা এগিয়ে থাকেন। হুমায়ুন আজাদ একদা বলেছিলেন, “মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।” অদক্ষদের মান-মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ববোধ কম থাকে। অন্যদিকে দক্ষ কর্মীদের ভেতর দক্ষতাকে ঘিরে একধরনের অহংবোধ তৈরি হয়। তাঁরা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু বস তো কেবল কাজ চান না, আনুগত্য চান, বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধাও চান। প্রতিভা, দক্ষতা আর কাজের অনুশাসন—এসব নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু এগুলোই যথেষ্ট নয়। অফিস কেবল কাজের জায়গা নয়, এটা হলো সম্পর্ক, ক্ষমতার ভারসাম্য আর মানবিক বোঝাপড়ার এক অদৃশ্য খেলা। যারা এই খেলা বুঝতে পারে না, তারাই ভেঙে পড়ে—কাজে অসাধারণ হলেও রাজনৈতিক কৌশলে পিছিয়ে যায়। পেশাদার হওয়ার মানে শুধু দক্ষতা নয়, বরং বুদ্ধিমত্তা, পরিপক্বতা, সম্মান আর সংবেদনশীলতার প্রকাশ। নিজের কাজকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উপস্থাপন করা, অন্যের সফলতায় আনন্দিত হওয়া, আর বিরোধের সময় শান্ত থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া—এসবই অফিস পলিটিক্স সামলানোর আসল শক্তি। অফিস পলিটিক্সের ফলে কর্মীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। দলের মধ্যে বিভেদ দেখা যায় এবং কাজের মান কমে যায়। এই ধরনের পরিস্থিতি সামলাতে না পারলে কর্মীর ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যার দরুন অফিসে একটি অস্বস্তিকর এবং নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি হয়। অফিস পলিটিক্স মোকাবিলা করতে নিজস্ব মূল্যবোধ এবং সীমা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে এবং সেগুলোর সঙ্গে আপস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কর্মক্ষেত্রে কী ঘটছে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং কোনো অপব্যবহার বা নেতিবাচক লক্ষণ দেখলে সতর্ক হতে হবে। ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, কিন্তু এটি যেন নিজ নৈতিক সীমানাকে অতিক্রম না করে। নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে পেশাগত সম্পর্ক থেকে আলাদা রাখতে হবে, যেন কর্মক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি না হয়। অফিস পলিটিক্সের মুখোমুখি হওয়া মানে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকে থাকা। এখানে যুক্তি, নীতি আর আবেগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। তাই অফিস পলিটিক্স থেকে নিজেকে দূরে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে এর থেকে দূরে থাকা এত সহজ নয়। অনেক সময় ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে এর সঙ্গে জড়াতে হয়। অফিস পলিটিক্সে জড়ালেও সেটি যেন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিত্বের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা যায়, সেই প্রচেষ্টা করতে হবে। কারও সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। ছোট একটা মনোমালিন্য হয়তো নিজ কর্মপরিবেশে স্থায়ী শত্রু তৈরি করে দেবে, যা নিজ অগোচরেই হয়তো ভুল ধরার কাজে সব সময় নিয়োজিত হয়ে যাবে। সহকর্মীর কাজে অযাচিত মনোনিবেশ না করে নিজের কাজে মনোযোগ দিতে হবে। সে ফাঁকি দিচ্ছে কি না, সেটার বিচার তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা করবেন। কারও অভ্যাস থাকে অন্যের কাজের ভুল খোঁজা, সেই খুঁজে পাওয়া ভুল ধরে সেই ব্যক্তিকে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডায় আলোচনা করে নিজেকে বড় প্রমাণ করতে চাওয়া—কিন্তু এ দুটি কাজই পলিটিক্স করার জন্য নতুন শত্রু তৈরি করে দেয়। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকা এবং সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে নিজেকে প্রমাণ করে অফিসের বড় কর্তাদের কাছে যোগ্যতার তালিকায় ঢুকতে হয়। নিজের কাছে কোনো কাজ ভুল মনে হলে প্রতিক্রিয়া দেখাতে যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করতে হবে। কিংবা যদি বলাটা একান্তই জরুরি মনে হয়, তাহলে নিয়ম মেনেই ভদ্রতার সঙ্গে বিষয়টি নজরে আনতে হবে—কিন্তু তর্ক করা যাবে না। অফিসে অন্যের ব্যক্তিগত কোনো সমস্যায় নিজেকে যুক্ত করা যাবে না, এমনকি মতামতও দেওয়া উচিত নয়। অনেকের অভ্যাস রয়েছে অফিসে অন্যের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর। নিজের মধ্যে এ প্রবণতা থাকলে সেটি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। আর যাদের মধ্যে এ অভ্যাস আছে তাদের সঙ্গ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। অফিসে নিজের মেজাজ দেখালে তা নিজের বিরুদ্ধেই পলিটিক্স গ্রুপ তৈরি করে দেবে। তাই সব সময় নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তবে অফিস পলিটিক্স সব সময় নোংরা খেলা নয়। কখনো এটি শেখায় কিভাবে জটিল সম্পর্ক সামলাতে হয়, কিভাবে চাপের মধ্যে স্থির থাকতে হয়, আর কিভাবে মানবিকতা ধরে রেখে পেশাগত জীবন এগিয়ে নিতে হয়। তাই এটিকে সর্বাবস্থায় নেতিবাচক না ভেবে—একটি শেখার ক্ষেত্র, একটি দক্ষতা বৃদ্ধির উপায় হিসেবে ধরতে পারলে কাজে মনোযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। অফিস পলিটিক্স নিয়ে নির্মোহ বোঝাপড়া জরুরি। যেহেতু চাকরি করতে হবে, সংসার চালাতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে—তাই এখানে কৌশলী হয়ে বাঁচতে হবে। নিজের পরিশ্রম, সততা আর মেধাই আসল শক্তি। কিন্তু সেই শক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কৌশল দরকার। তবে তা কখনো নিজের আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে নয়। লেখক: সহ সম্পাদক,সমাজকল্যাণ বিভাগ, পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক)। ডেল্টা টাইমস/রেহানা ফেরদৌসী/সিআর/আইইউ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |